মেলাজমা হওয়ার কারণ, প্রতিরোধ ও চিকিৎসা

মেলাজমা দাগের লক্ষণ ও সমাধান

আমাদের ত্বকের সৌন্দর্য নষ্ট করার জন্য, খুবই সাধারণ সমস্যা হলো মেলাজমা। এটি আমাদের ত্বকে বাদামি, ধূসর বা গাঢ় দাগ আকারে দেখা যায়, যা আমাদের ত্বকের সাথে সাথে আত্মবিশ্বাস কেও প্রভাবিত করে। অনেকেই এটাকে শুধু একটা দাগ হিসেবে অবহেলা করেন, কিন্তু আসলে মেলাজমা একটি জটিল স্কিন কন্ডিশন। এর পিছনে বিভিন্ন কারণ, উপসর্গ ও ঝুঁকি ফ্যাক্টর রয়েছে। তবে সুখবর হলো, সঠিক প্রতিরোধ, চিকিৎসা ও জীবনযাপনের পরিবর্তনের মাধ্যমে এটি নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব।

মেলাজমা কী?

এটি এক ধরনের হাইপারপিগমেন্টেশন সমস্যা, যা ত্বকে বাদামি বা ধূসর রঙের দাগ তৈরি করে। সাধারণত এটি বেশি হয় কপাল, নাক ও ঠোঁটের উপরের অংশে। পুরুষদের তুলনায় নারীরা এই মেলাজমা বা মেসতায় বেশি আক্রান্ত হয়। বিশেষ করে গর্ভাবস্থা বা হরমোন পরিবর্তনের সময়ে মেস্তার বেশি দেখা যায়।

মেলাজমার কারণসমূহ

মেলাজমা বা মেস্তার দাগ

মেলাজমার বা মেসতা বিভিন্ন কারণে হয়ে থাকে। তার মধ্যে কিছু গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো –

  • সূর্যের অতিবেগুনি রশ্মি (UV exposure) – সূর্যের অতি বেগুনি রশ্মি আমাদের ত্বকে মেলানিন উৎপাদন বাড়িয়ে দেয়, যার ফলে দাগ স্পষ্ট হয়। নিয়মিত সানস্ক্রিন ব্যবহার না করলে মেলাজমা আরও বেশি খারাপ হতে পারে।
  • হরমোন পরিবর্তন (গর্ভাবস্থা, জন্মনিয়ন্ত্রণ পিল ইত্যাদি) – গর্ভাবস্থায় অনেক নারী মেলাজমার দাগ লক্ষ্য করেন। এছাড়া জন্মনিয়ন্ত্রণ পিল বা হরমোনাল থেরাপিও এর জন্য দায়ী হতে পারে।
  • জেনেটিক ফ্যাক্টর – যদি আপনার পরিবারের কারও মেলাজমা থেকে থাকে, তবে আপনারও মেলাজমার ঝুঁকি বেড়ে যেতে পারে।
  • স্কিন ইনফ্লেমেশন বা পূর্বের ইনজুরি – আগে আপনার ত্বকে যে জায়গায় ব্রণ হয়েছে বা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে সে জায়গা মেলাজমায় রূপ নিতে পারে।
  • অতিরিক্ত কেমিক্যাল ও কসমেটিক্স ব্যবহার – হার্শ কেমিক্যাল বা নন-ডার্মাটোলজিক্যাল কসমেটিক্স ব্যবহার ত্বককে ক্ষতিগ্রস্ত করে মেলাজমা বাড়ায়। 

মেলাজমার লক্ষণ ও উপসর্গ

১) মুখে বাদামি বা ধূসর দাগ মেলাজমা হওয়ার সবচেয়ে স্পষ্ট লক্ষণ হলো মুখে স্বাভাবিক রঙ থেকে আলাদা, অসমান রঙের দাগ ছোপ পড়া। মেসতা সাধারণত বাদামি, হালকা বাদামি বা ধূসর রঙের হয়ে থাকে। অনেক সময় পর্যন্ত রোদে থাকলে দাগগুলো গাঢ় হয়ে যায়। 

২) সাধারণত গাল, কপাল, নাক ও ঠোঁটের উপরে বেশি দেখা যায় – মেলাজমা মূলত সেসব জায়গায় বেশি হয় যেখানে সূর্যরশ্মি বেশি পড়ে, যেমন- গাল, কপাল, নাকের ব্রিজ এবং ঠোঁটের উপরের অংশে। যারা সানস্ক্রিন ছাড়া বাহিরে বেশি সময় কাটান তাদের মধ্যে এ দাগ বেশি লক্ষ্য করা যায়। 

৩) দাগের আকার ও গাঢ়তার পার্থক্য – মেসতার ক্ষেত্রে সবার দাগ একরকম নাই হতে পারে। কারও দাগ হালকা বাদামি হয়, যেটা মেকআপ দিয়ে ঢেকে ফেলা যায়। আবার কারও দাগ এতটাই গাঢ় হয় যে সহজে ঢাকে না। মেলাজমাকে অনেকেই “ফ্লাকচুয়েটিং” পিগমেন্টেশন সমস্যা বলে থাকেন।

মেলাজমা নির্ণয়ের পদ্ধতি

  • ডার্মাটোলজিস্টের স্কিন এক্সামিনেশন – আপনার ত্বকে মেলাজমা সঠিকভাবে চিহ্নিত করার প্রথম ধাপ হলো চর্মরোগ বিশেষজ্ঞের ভিজ্যুয়াল পরীক্ষা। চর্মরোগ বিশেষজ্ঞ সাধারণ ভিজ্যুয়াল পরীক্ষার মাধ্যমে মেলাজমা নির্ণয় করেন।
  • উডস লাইট টেস্ট – এই টেস্টের মাধ্যমে দাগ কতটা গভীরে পৌঁছেছে তা বোঝা যায়। যখন শুধুমাত্র চোখে দেখে বোঝা যায় না দাগ কতটা গভীরে বসে আছে, তখন ডাক্তার উডস লাইট টেস্ট করেন।
  • বায়োপসি (খুব কম ক্ষেত্রে) – যদিও খুবই বিরল, তবে কিছু জটিল ক্ষেত্রে স্কিন বায়োপসি করা হয়। এতে আক্রান্ত জায়গা থেকে একটি ছোট টিস্যু স্যাম্পল সংগ্রহ করে ল্যাবরেটরিতে মাইক্রোস্কোপের নিচে পরীক্ষা করা হয়।

মেলাজমার চিকিৎসা

মেলাজমার চিকিৎসা

(ক) মেডিক্যাল ট্রিটমেন্ট)

  • Hydroquinone cream – এটি আমাদের ত্বকের অতিরিক্ত মেলানিন উৎপাদন কমায়, যা দাগ হালকা করে। এটি ডাক্তারের পরামর্শে ব্যবহার করা হয়।
  • Retinoids (Retinol, Tretinoin) – ত্বকের নতুন কোষ তৈরিতে সাহায্য করে, এবং পিগমেন্টেশন কমায়।
  • Corticosteroid creams – প্রদাহ ও জ্বালাপোড়া কমিয়ে দাগ হালকা করতে সাহায্য করে।
  • Vitamin C serum – এটি একটি শক্তিশালী অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট যা ত্বক উজ্জ্বল করে এবং দাগ কমাতে সহায়তা করে।

(খ) ক্লিনিক্যাল ট্রিটমেন্ট)

  • Chemical peel – বিশেষ কেমিক্যাল দিয়ে তৈরি পিল মাস্ক যা ত্বকের উপরের স্তর তুলে দেয়, যা নতুন উজ্জ্বল ত্বক তুলে নিয়ে আসে।
  • Microdermabrasion – ছোট ছোট ক্রিস্টাল দিয়ে ত্বক এক্সফোলিয়েট করা হয়, এতে দাগ ও ডার্ক স্পট হালকা হয়।
  • Laser therapy – লেজার পদ্ধতির মাধ্যমে মেলানিন ভেঙে দেওয়া হয়, যা গাঢ় দাগ কমাতে সাহায্য করে।

ঘরোয়া উপায় ও প্রাকৃতিক চিকিৎসা

  • অ্যালোভেরা জেল – অ্যালোভেরার মধ্যে থাকা শীতলকারী গুণ ত্বকের জ্বালাপোড়া কমায়, এবং মেলানিন উৎপাদন নিয়ন্ত্রণ করে। নিয়মিত এলোভেরা ব্যবহারে মেলাজমার দাগ ধীরে ধীরে হালকা হয় এবং ত্বক আরও নরম ও মসৃণ হয়ে ওঠে।
  • হলুদ ও দুধের প্যাক – হলুদে থাকা কারকিউমিন খুবই শক্তিশালী অ্যান্টি-ইনফ্ল্যামেটরি ও অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট। এটি ত্বকের মেসতা কমাতে সাহায্য করে, আর দুধের ল্যাকটিক অ্যাসিড ত্বক উজ্জ্বল করে। এই দুইয়ের একসাথে ব্যবহার দাগ হালকা করে ও ত্বকের রঙ সমান করে।
  • মধু ও দই মাস্ক – মধু ও দইয়ে থাকা অ্যান্টিব্যাকটেরিয়াল গুণ আর ল্যাকটিক অ্যাসিড আমাদের ত্বক এক্সফোলিয়েট করে। এই দুইটা ত্বকের পুষ্টি প্রদান করে, উজ্জ্বল করে ও ত্বকের মেলাজমার দাগ হালকা করে।

প্রতিরোধের উপায়

  • নিয়মিত সানস্ক্রিন ব্যবহার (SPF 30 বা বেশি) – মেলাজমা বা পিগমেন্টেশন সমস্যা কমানোর সবচেয়ে কার্যকর উপায় হলো প্রতিদিন (SPF 30 বা বেশি) সানস্ক্রিন ব্যবহার। সকালে বের হওয়ার ১৫ থেকে ২০ মিনিট আগে লাগান এবং প্রতি ২-৩ ঘণ্টা পর পর পুনরায় ব্যবহার করুন।
  • সরাসরি রোদ এড়িয়ে চলা – দুপুর ১১টা থেকে বিকেল ৩টা পর্যন্ত সূর্যের রশ্মি সবচেয়ে তীব্র থাকে। এসময় সরাসরি রোদে না গেলে মেলাজমা ও অন্যান্য সান ড্যামেজ কমানো যায়। আর যদি বের হতেই হয় চেষ্টা করুন ছায়াযুক্ত জায়গায় থাকার। 
  • টুপি ও সানগ্লাস ব্যবহার – সানস্ক্রিন এর সাথে সাথে টুপি, সানগ্লাস এবং ছাতা ব্যবহার করুন যা আপনার ত্বককে অতিরিক্ত সুরক্ষা প্রদান করে। 
  • অপ্রয়োজনীয় কেমিক্যাল প্রোডাক্ট এড়িয়ে চলা – অনেক বেশি হার্শ / শক্তিশালী স্কিনকেয়ার বা অজানা কেমিক্যালযুক্ত প্রোডাক্ট ত্বকের সংবেদনশীলতা বাড়ায় এবং মেলাজমা আরও খারাপ করতে পারে।

মেলাজমা ও অকাল বার্ধক্যের সম্পর্ক

  • সূর্যের ক্ষতি + হরমোন + এজিং – সূর্যের ক্ষতিকারক UV রশ্মি আমাদের ত্বকের কোলাজেন ভেঙে দেয়, হরমোনের ভারসাম্য নষ্ট করে এবং কোষ পুনর্গঠন ধীর করে ফেলে। যার ফলে মেলাজমা ও অকালবার্ধক্য দুটোই একসাথে বেড়ে যায়।
  • কিভাবে প্রিভেনশন করলে দুটো সমস্যাই কমানো যায় – নিয়মিত সানস্ক্রিন ব্যবহার করুন যা মেলাজমা ও বার্ধক্যের দাগ দুটোই প্রতিরোধ করে। ত্বক সবসময় হাইড্রেটেড রাখুন যা কোলাজেন সাপোর্ট করে এবং ত্বককে মসৃণ রাখে। অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট সমৃদ্ধ প্রোডাক্ট যেমন ভিটামিন সি সিরাম যা ফ্রি র‍্যাডিক্যালের ক্ষতি কমিয়ে ত্বককে দীর্ঘ সময় তারুণ্য ধরে রাখতে সাহায্য করে।

প্রচলিত ভ্রান্ত ধারণা (Myths vs Facts)

১. * Myth – মেলাজমা বা মেসতা শুধু গর্ভাবস্থায় হয়ে থাকে।

* Fact – এটি নারী-পুরুষ উভয়েরই হতে পারে এবং হরমোন, রোদ, ও জেনেটিক কারণেও হতে পারে।

 

২. * Myth – শুধু ক্রিম ব্যবহার করলেই মেসতা চলে যায়।

* Fact – কার্যকর চিকিৎসার জন্য মেডিকেল ট্রিটমেন্ট এর সাথে লাইফস্টাইল পরিবর্তন দুইটাই দরকার।

 

৩. * Myth – মেলাজমা একেবারে সরানো সম্ভব।

* Fact – একেবারে পুরোপুরি সরানো সম্ভব না, তবে সঠিক জীবন-যাপন, চিকিৎসা, এবং নিয়ম মানলে নিয়ন্ত্রণ রাখা সম্ভব।