আমাদের অনেকের মুখ মাঝে মাঝে বেশ চকচকে দেখায়, বিশেষ করে গরমের সময় বাহিরে গেলে এটি বেশি হয়। সাধারণত আমরা এটাকে তৈলাক্ত বা অয়েলি স্কিন বলে থাকি। এর মানে হলো আপনার চেহারায় তেল উৎপাদন বেশি হয়, যা চকচকে ভাবটা বাড়িয়ে দেয়। আসলে আমাদের ত্বকে ছোট ছোট গ্রন্থি রয়েছে এক প্রকার তেল তৈরি করে যাকে সিবাম ও ডাকা হয়।
এই তেল বা সিবাম আমাদের ত্বকের আর্দ্রতা ধরে রাখে সাথে সুরক্ষাও দেয়। তবে যখন এই তেলের পরিমান প্রয়োজন থেকে বেশি হয়ে পড়ে তখন মুখে অতিরিক্ত তেল জমে। এই অতিরিক্ত তেল জমার কারণে আমাদের ত্বকে ব্রণ ও ব্ল্যাকহেডস দেখা দেয় এবং ত্বক সবসময় ময়লা ও ক্লান্ত দেখায়। এই সমস্যাকে নিয়ন্ত্রণ করতে হলে আমাদের আগে বুঝতে হবে এর কারণগুলো কী এবং এরপর ঘরোয়া উপায় ও সঠিক স্কিনকেয়ার।
তৈলাক্ত ত্বকের কারণ
তৈলাক্ত ত্বকের প্রকৃত কারণগুলো জানা জরুরি, কারণ সঠিক কারণ বুঝতে পারলেই নেওয়া যায় সঠিক সমাধান। তৈলাক্ত ত্বকের সাধারণ কারণ গুলো নিয়ে কথা বলি –
১) হরমোনাল পরিবর্তন:
অয়েলি স্কিনের সবচেয়ে বড় কারণ হলো হরমোন। এই হরমোনাল পরিবর্তন হয় বিশেষ করে কিশোর বয়সে, মাসিক চলাকালীন সময়ে, গর্ভাবস্থায় বা জন্মনিয়ন্ত্রণ পিল এর কারণে। এসবের কারণে শরীরে অ্যান্ড্রোজেন হরমোন বেড়ে যায়। এর ফলে সেবাসিয়াস গ্ল্যান্ড অনেক বেশি তেল তৈরি করে। তাই বেশিরভাগ যাদের অয়েলি স্কিন ও ব্রণ হয় তা হরমোনের কারণেই হয়।
২) অস্বাস্থ্যকর খাদ্য ও জীবনধারা:
আমরা কি খাদ্য গ্রহণ করি তা আমদের ত্বকের উপর সরাসরি প্রভাব সৃষ্টি করে। অতিরিক্ত তেল চর্বিযুক্ত খাবার, বাহিরের খাবার, খুব বেশি মিষ্টি বা সোডা পানি শরীরের ভেতর ইনফ্লেমেশন বেড়ে যায়, যা ত্বকে তেল উৎপাদন বাড়ায়। সাথে ত্বকে তৈলাক্ততা বৃদ্ধি পেতে পারে পর্যাপ্ত পানি অভাবে। পর্যাপ্ত পানি না খাওয়াও একটি বড় সমস্যা। শরীর ডিহাইড্রেটেড হলে স্কিন নিজেকে আর্দ্র রাখার জন্য অতিরিক্ত তেল তৈরি করে।
৩) ভুল স্কিনকেয়ার প্রোডাক্ট:
আমাদের অনেকেরই সাধারণ একটা ভুল ধারণা হলো স্কিন যতবার ধোয়া যায় তত ভালো। কথাটি মোটেও সত্যি নয়, অতিরিক্ত ফেসওয়াশ ও বার বার ফেসওয়াশ ব্যবহার করে ত্বক পরিষ্কার করা খারাপ। অতিরিক্ত ফেসওয়াশ ব্যবহার এবং হেভি অয়েল-বেসড ক্রিম ব্যবহার করলে ত্বক আরও তেল তৈরি করতে শুরু করে। অয়েলি স্কিনের জন্য তাই খুব বুঝে শুনে প্রোডাক্ট ব্যবহার করা উচিত। অয়েলি স্কিনের জন্য কি কি ব্যবহার করতে পারেন তা নিচে দিয়ে দিচ্ছি।
৪) বাতাস ও পরিবেশ দূষণ:
আমরা নিত্যদিন বাহিরে বের হই, নানান কাজে বাহিরে যাওয়া লাগে। বাইরের ধুলোবালি, ঘাম আর দূষণের কারণে পোরস বন্ধ করে দেয়। যখন এই পোরস বন্ধ হয়ে পড়ে, তখন আমাদের ভেতরে সেবাম জমে থাকে এবং মুখ আরও অয়েলি বা তৈলাক্ত দেখায়। এই ব্রণ বন্ধ হয়ে যাবার কারণে আমাদের ত্বকে ব্রণ ও ব্ল্যাকহেডস তৈরি হয়।
ঘরোয়া সমাধান
তৈলাক্ত ত্বক মানেই যে শুধু দামি দামি প্রোডাক্ট ব্যবহার করতে হবে ব্যাপারটা এমন নয়। ত্বকের যত্নে অনেক সময় দামি প্রোডাক্টের দরকার পড়ে না। আমাদের ঘরে থাকা উপাদান দিয়ে সহজেই তৈলাক্ত ত্বকের সমাধান আনা সম্ভব। নিয়মিত এই ঘরোয়া উপায়গুলো মেনে চললে ত্বক স্বাভাবিক ভারসাম্যে ফিরে আসবে।
অ্যালোভেরা জেল
আমাদের ত্বকের জন্য অ্যালোভেরা একটি প্রাকৃতিক উপহার। এটি আমাদের ত্বকে প্রাকৃতিক ময়েশ্চারাইজার হিসেবে কাজ করে। এটি আমাদের ত্বককে আর্দ্র রাখে, যা ত্বকে কোনোভাবেই তেলতেলে হতে দেয় না। এতে থাকা অ্যান্টি-ব্যাকটেরিয়াল প্রপার্টি ব্রণ প্রতিরোধ করে এবং ত্বককে সতেজ রাখে। প্রতিদিন রাতে অ্যালোভেরা জেলের পাতলা আবরণ ব্যবহার করলে ত্বক ওয়েল কন্ট্রোল করা সম্ভব হয়।
মুলতানি মাটি + গোলাপ জল প্যাক
মুলতানি মাটি আমাদের ত্বকের যত্নে শতাব্দী ধরে কাজ করে আসছে। এটি আমাদের অয়েলি স্কিনের প্রাকৃতিক সমাধান হিসেবে খুব ভালো কাজ করে। মুলতানি মাটি সপ্তাহে কয়েকদিন ব্যবহার করলে এটি আমাদের ত্বকের অতিরিক্ত তেল শোষণ করে এবং পোরস পরিষ্কার করে। মুলতানি মাটি ব্যবহার করার সময় চেষ্টা করুন গোলাপ জল মেশানোর যা ত্বককে টোনড করে এবং ব্রণ হওয়ার প্রবণতা কমায়।
লেবু ও মধু মাস্ক
লেবুতে থাকা অ্যাসিড আমাদের ত্বকের অতিরিক্ত তেল নিয়ন্ত্রণ করে। লেবুতে থাকা প্রাকৃতিক সাইট্রিক অ্যাসিড ত্বকের অতিরিক্ত তেল কমায় এবং মধু ত্বককে নরম ও আর্দ্র রাখে। তাই তৈলাক্ত ত্বকের সমস্যা দূর করতে লেবু ও মধু মাস্ক বানিয়ে সপ্তাহে এক-দুইবার ব্যবহার করতে পারেন। সেনসিটিভ স্কিনে সরাসরি লেবু ব্যবহার করলে জ্বালা করতে পারে, তাই আগে প্যাচ টেষ্ট করে পরে ব্যবহার করুন।
টমেটো / শসা প্যাক
টমেটোতে আছে প্রাকৃতিক অ্যাস্ট্রিনজেন্ট যা পোরস ছোট করে এবং ত্বকের অয়েল কমায়। অন্যদিকে শসা ত্বককে ঠাণ্ডা ও সতেজ রাখে, যা গরম কালের জন্য বিশেষভাবে উপকারী।
বিভিন্ন প্রোডাক্ট সাজেশনস
তৈলাক্ত ত্বকের যত্নে সঠিক প্রোডাক্ট ব্যবহার করা খুব গুরুত্বপূর্ণ। ভুল ফেসওয়াশ, ময়েশ্চারাইজার বা মেকআপ ত্বকের তেলতেলে ভাব আরও বাড়িয়ে দিতে পারে। তাই দৈনন্দিন স্কিনকেয়ার রুটিনে এমন প্রোডাক্ট ব্যবহার করা উচিত যা তেল নিয়ন্ত্রণ করে। নিচে কিছু তৈলাক্ত ত্বকের জন্য প্রয়োজনীয় প্রোডাক্ট সাজেশন দেওয়া হলো, যা নিয়মিত ব্যবহার করলে তৈলাক্ত ত্বক অনেকটাই নিয়ন্ত্রণে থাকবে –
১) ফেসওয়াশ –
অয়েলি স্কিনের জন্য জেল-বেসড বা ফোমিং ফেসওয়াশ বেছে নিন। এগুলো ত্বকের অতিরিক্ত তেল তুলতে সাহায্য করে তবে আপনার ত্বক একদম শুষ্ক করে ফেলে না।
২) টোনার –
অ্যালকোহল-ফ্রি টোনার ব্যবহার করুন। এটি তৈলাক্ত ত্বকের পিএইচ লেভেল ঠিক থাকে এবং পোরস টাইট করে। গ্রিন টি বা উইচ হ্যাজেল বেসড টোনার অয়েলি স্কিনের জন্য বেশ ভালো।
৩) ময়েশ্চারাইজার –
আমাদের অনেকেরই ভুল ধারণা যে অয়েলি স্কিনে ময়েশ্চারাইজার দরকার নেই। এটি খুবই একটি ভুল ধারণা, অয়েলি স্কিনের জন্য লাইটওয়েট, অয়েল-ফ্রি ও নন-কমেডোজেনিক ময়েশ্চারাইজার ব্যবহার করা ভালো। এটি আপনার ত্বককে হাইড্রেটেড রাখে এবং অতিরিক্ত তেল উৎপাদন কমায়।
৪) সানস্ক্রিন ব্যবহার –
আপনার স্কিন যেমনই হোক না কেন সানস্ক্রিন অবশ্যই অবশ্যই ব্যবহার করা লাগবে। অয়েলি স্কিনেও সানস্ক্রিন ব্যবহার অবশ্যই জরুরি। তবে অয়েলি স্কিনের জন্য জেল-বেসড, অয়েল-ফ্রি বা ম্যাট ফিনিশ ফর্মুলা বেছে নিন। এতে ত্বকে তেলতেলে ভাব আসবে না।
৫) ক্লে মাস্ক ব্যবহার –
ক্লে মাস্ক ব্যবহার আমাদের ত্বকে ডিপ ক্লিনজিং করে। এটি আমাদের ত্বকে জমে থাকা অতিরিক্ত তেল টেনে বের করে। সপ্তাহে ১–২ বার ব্যবহার করলে অয়েল কন্ট্রোলের পাশাপাশি ব্রণও কমে যায়।
৬) মেকআপ প্রোডাক্ট –
অয়েলি স্কিনের জন্য সবসময় নন-কমেডোজেনিক, অয়েল-ফ্রি এবং ম্যাট ফিনিশ মেকআপ বেছে নিতে হবে। এতে ত্বকে ভারী ভাব আসবে না এবং সাথে মেকআপও দীর্ঘস্থায়ী হবে।
উপসংহার
অয়েলি স্কিন নিয়ন্ত্রণের জন্য শুধু ঘরোয়া উপায় নয়, বরং সঠিক স্কিনকেয়ার রুটিন এবং জীবনযাপনও জরুরি। প্রচুর পানি পান করা, স্বাস্থ্যকর খাবার খাওয়া, এবং সঠিক প্রোডাক্ট ব্যবহার করলে ত্বক অনেকটাই নিয়ন্ত্রণে আসে। মনে রাখবেন, তৈলাক্ত ত্বক একেবারে খারাপ নয়, বরং এটি বয়সের ছাপ দেরিতে আনে। তবে অতিরিক্ত তেল থেকে যদি ব্রণ বা অন্যান্য সমস্যা তৈরি হয়, সেক্ষেত্রে ঘরোয়া টিপস ও সঠিক স্কিনকেয়ারই হতে পারে আপনার সমাধান।